চাঁদ দুই ভাগ হওয়া এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর মিরাজের ঘটনা কি মিথ্যা?

প্রশ্নঃ চাঁদ দুই ভাগ হওয়া এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর মিরাজের ঘটনা কি মিথ্যা?

লিখেছেনঃ এম ডি আলী

উত্তরঃ প্রথমে আমরা চাঁদ দুই ভাগ ব্যাপারে আলোচনা করব ।

* সিরাতুল মুস্তফা (সা) ১/ ২০৭,২০৯, আল্লামা ইদরিস কান্ধলবি (রহ): একবার মুশরিকগন একত্রিত হয়ে নবী (সা) এর কাছে এলো। যাদের মধ্যে ওলিদ ইবনে মুগিরা, আবু জায়েল, আস ইবনে ওয়ায়েল, আস ইবনে হিশাম, আসওয়াদ ইবনে আবদ ইয়াগুস, আসওয়াদ ইবনে মুত্তালিব, নযর ইবনে হারিস ছিল । এরা নবী মুহাম্মদ (সা) এর কাছে এসে আবদার করলো, যদি আপনি সত্যিই আল্লাহ্‌র নবী হয়ে থাকেন তবে নবুওয়াতের বিশেষ কোন নিদর্শন দেখান । চাঁদকে দুই টুকরা করে দেখান । তখন রাত ছিল । নবী (সা) বলেন, যদি এ মোজেজা দেখাই তাহলে ইমান আনবে তো ? তারা বলল হ্যাঁ । আমরা ইমান আনব । নবী (সা) আল্লাহ্‌র নিকট দোয়া করলেন এবং পবিত্র আঙুল দিয়ে চাঁদের প্রতি ইশারা করলেন, সাথে সাথে চাঁদ দুই টুকরা হয়ে গেল । এক টুকরা আবু কুবায়স পাহাড়ের উপর এবং ওপর টুকরা কায়কোয়ান পাহাড়ের উপর ছিল । দীর্ঘক্ষণ মানুষ আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকে এবং ওরা এত আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল যে, কাপড় দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে থাকে । এবং চাঁদের দিকে দেখতে থাকে, এতে চাঁদ পরিষ্কার দুই টুকরা দেখা যেতে থাকে ।

রাসুল (সা) তখন বলছিলেন আশহাদু, আশহাদু , হে লোকেরা সাক্ষ্য থাকো, সাক্ষ্য থাকো। আসর এবং মাগরিবের মধ্যে যতটা সময় থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত চাঁদ দু টুকরা থাকে, পরে আবার তা একত্রিত হয়ে যায় । মক্কার মুশরিকরা বলল, মুহাম্মদ তুমি যাদু করেছ, তাই বাইরে থেকে আগত মুসাফিরদের অপেক্ষা করো এবং তাদের জিজ্ঞেস করো । কেননা এটা কখনোই সম্ভব না যে মুহাম্মদ সমস্ত লোকের উপর যাদু করবে । যদি তারাও এ ব্যাপারে নিজেরা সাক্ষ্য দেয়, তবে ঠিক আছে। যদি তারা বলে, আমরা দেখিনি, তবে নিশ্চিত মুহাম্মদ তোমাদের উপর যাদু করেছে । পরে মুসাফিরদের জিজ্ঞেস করা হয় , সমস্ত দিক থেকে আগত মুসাফিররা সাক্ষ্য দিল যে, আমরা চাঁদকে দুই টুকরো হতে দেখেছি । তারপরেও ঐ মুশরিকরা ইমান আনল না । বরং বলল, এটা চিরাচরিত যাদু ।

চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা আরও পাবেনঃ

* আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩/১১৮ ।
* ই,ফা, সিরাতে বিশ্ব কোষ , ৯/২৫৯ ।
* ই,ফা, সহিহ বুখারি, ৬/ ২৪৭ ও ৩৯৭ ।
* বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার প্রকাশিত, সহিহ মুসলিম, ৮/৩৬০ ।

উপরের ঘটনা থেকে আমাদের কিছু দাবী, প্রশ্ন এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যাঃ

১/ উপস্থিত সব কাফেররা অস্বীকার করেনি যে "মুহাম্মদ তুমি চাঁদকে দুই ভাগ করতে পারোনি" বরং তারা বলেছিল "মুহাম্মদ তুমি যাদু করেছ" অর্থাৎ এটা থেকে প্রমান হয় নবীজি (সা) কাফেরদের চাঁদ দুই ভাগ করে দেখিয়েছিলেন , সেটা কাফেরদের কাছে যাদু মনে হয়েছে।

২/ ঘটনার বাইরে যারা সফরে ছিলেন তারাও সাক্ষী দিয়েছেন যে তারা চাঁদকে দুই ভাগ হতে দেখেছে ।

৩/ দুনিয়ার সবাই কেন দেখল না ? উত্তর হলঃ যেহেতু ঘটনা ঘটেছে রাতে আর তাও ১ ঘণ্টার জন্য (আছর থেকে মাগরিব সময়) তাই দুনিয়ার সবার দেখা সম্ভব ছিল না । কারন এক দেশে যখন রাত অন্য দেশে তখন দিন থাকে ।

৪/ চাঁদ দুই ভাগ হওয়া অসম্ভব না বরং এটি একটি ছোট বিষয় । এরচেয়ে বড় বিষয় হল এক সময় সব ধ্বংস হয়ে যাবে । এটি বিজ্ঞান মামারাও বলে । সুতরাং চাঁদ এক সময় ধ্বংস হবে এটা বড় ব্যাপার, এটা মানতে আমাদের অসুবিধা নেই তাহলে আল্লাহ্‌র হুকুমে মাত্র ১ ঘণ্টার জন্য চাঁদ দুই ভাগ হয়েছিল এটা মানতে আমাদের কেন অসুবিধা হবে ?

৫/ প্রকৃতির এক ধর্ম হল মধ্যকর্ষণ শক্তি যা সবসময় নিচের দিকে টানে । কিন্তু মানুষ প্রকৃতির এই নিয়ম ভেঙ্গে প্ল্যান তৈরি করেছে যে আকাশে উড়ে । তাহলে মানুষ যদি প্রকৃতির এই নিয়ম ভাঙতে পারে তাহলে সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্‌ যিনি প্রকৃতির সৃষ্টিকর্তা, চাঁদের সৃষ্টিকর্তা কেন কিছু সময়ের জন্য চাঁদকে দুই ভাগ করে আবার মিলাতে পারবে না ? অবশ্যই পারবে । এটা আল্লাহ্‌র জন্য খুবই সহজ ।

৬/ "চাঁদের এক টুকরা আবু কুবায়স পাহাড়ের উপর এবং ওপর টুকরা কায়কোয়ান পাহাড়ের উপর ছিল" এটা কিভাবে পসিবল ? উত্তর হলঃ চাঁদের উক্ত অংশ পাহাড়ের সাথে ঘেঁষে ছিল এমনটি নয় বরং যখন চাঁদ দুই ভাগ হয় তখন এক ভাগ আবু কুবায়স পাহাড়ের উপর ছিল আরেক ভাগ কায়কোয়ান পাহাড়ের উপর ছিল এরমানে এই না যে পাহাড়ের মধ্যে ঘেঁষে ছিল আর মানুষ সেই অংশ নিজ হাতে ধরেছে ! এমন কিছুই নয় । যেমন আমরা দেখি সূর্য পানিতে ডুবে যায় , যখন ডুবে তখন মনে হয় পানির উপরেই সূর্য নেমেছে, আসলে তা না , একই ভাবে চাঁদের ক্ষেত্রেও ।

৭/ আল ইসাবাহ, ৩/২৭৯ এবং লিসানুল মীযান জাহাবি ৩/১০ আছেঃ ভারতের বর্তমান কেরালা প্রদেশের মালাবার অঞ্চলের "কোডুঙোলর" এলাকায় ২৬ বছর সম্রাট ছিলেন রাজা চেরেমান পেরুমল । তার উপাধি চক্রবতি ফারমাস । রাসুল (সা) এর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হবার মোজেজা তিনি ভারত থেকে স্বচক্ষে অবলোকন করেন। মালাবারে আগত আরব বণিকদের থেকে তিনি নবিজির খবর পান এবং মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন । সেখানে রাসুল (সা) এর সাথে দেখা হয় ও ইসলাম গ্রহণ করে । আবু বকর (রা) সহ আরও কয়েকজন সাহাবীর উপস্থিতিতে স্বয়ং আল্লাহ্‌র হাবীব (সা) নাম রাখেন "তাজউদ্দিন" । রাজা চেরামান পেরুমল রাসুলের জন্য উপহার স্বরূপ দক্ষিন ভারতের বিখ্যাত আচার নিয়ে গিয়েছিলেন । ভারতীয় এক বাদশাহ থেকে আদার সংমিশ্রণে তৈরি সেই আচার সংক্রান্ত হাদিসও আমরা দেখতে পাই। প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাইদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে হাদিসটি । হাদিস সংকলনকারী হাকিম (রহ) তাঁর "মুস্তাদরাক" নামক কিতাবে হাদিসটি সংকলন করেছেন । আবু সাইদ খুদরি (রা) থেকে বর্ণিত ভারতীয় মহারাজ নবীজি (সা) এর জন্য এক বয়াম আচার নিয়ে আসলেন যার মধ্যে আদার টুকরা ছিল । নবীজি (সা) সেই টুকরোগুলো তাঁর সাহাবীদের ভাগ করে দিলেন । আমিও খাবার জন্য এক টুকরা ভাগে পেয়েছিলাম । রাজা চেরামান পেরুমল ৪,৫ বছর সেখানে অবস্থান করেন । রাসুলের আদেশে ভারতে রওনা হন কিন্তু পথিমধ্যে দক্ষিন পূর্ব আরবের এক বন্দরে (বর্তমানে ওমানের সালালা শহর) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মারা যান । আজও তাঁর কবর রয়েছে ওমানের সালালা শহরে ।"সারবানাক" নামে আরবরা তাঁকে চিনত । (ই,ফাঃ তাফসীরে মারেফুল কুরআন, ৮ খণ্ড, সুরা কামারের তাফসীর, "তারিখে ফিরিশতা" কিতাবের বরাতে এই ঘটনা উল্লেখ আছে)

নবী মুহাম্মদ (সা) এর মেরাজের ঘটনাঃমেরাজের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

* সিরাতুন নবী (সা) , ২/ ৭২-৮২, ইবনে হিশাম (রহ): রাসুল (সা) একটি বোরাখের মাধ্যমে মিরাজ গমন করেন । বোরাখ একটি চতুস্পদ জন্তু । এটি এত দ্রুত যে, তার এক একটি পদক্ষেপ হয় তার দৃষ্টির শেষ সীমানা । রাসুল (সা) মিরাজে গমনকালে জান্নাত,জাহান্নাম সহ সব দেখেন। এমনকি নবী রাসুলদের সাথে দেখা হয় । ইত্যাদি ইত্যাদি । পরদিন ফজরের পর সকালে কুরাইশদের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করেন । কাফেররা অস্বীকার করে ও হাসাহাসি করে । হযরত আবু বকর (রা) এর কাছে মিরাজের খবর পৌঁছলে তিনি রাসুল (সা) এর কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহ্‌র নবী আপনি কি এদের কাছে বলেছেন যে , ঐ রাতে আপনি বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলেন ? তিনি বললেন, হ্যাঁ । আবু বকর (রা) বলেন, হে আল্লাহ্‌র নবী সে মসজিদটির বর্ণনা দিন তো কারন আমি সেখানে গিয়েছিলাম ।

তখন রাসুল (সা) বললেন, তখন আমার সামনে বায়তুল মুকাদ্দাসকে তুলে ধরা হল আর আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম । এরপরে রাসুল (সা) আবু বকর (রা) কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের বর্ণনা দিতে লাগলেন । আর আবু বকর (রা) প্রতিবারই বলতে থাকেন, আপনি সত্যিই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহ্‌র রাসুল । এরপরেই রাসুল (সা) আবু বকর (রা) কে সত্যবাদী তথা সিদ্দিক উপাধি দেয় ।

* ই,ফাঃ সহিহ বুখারি, ৬/৪০৮, হাদিসঃ ৩৬০৭ সহিহ হাদিসঃ জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত তিনি রাসুল (সা) কে বলতে শুনেছেন, যখন মিরাজের ব্যাপারে কুরাইশরা অস্বীকার করলো, তখন আমি কাবা শরীফের হিজর অংশে দাঁড়ালাম । আল্লাহ্‌ পাক তখন আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রকাশ করে দিলেন । যার ফলে আমি দেখে দেখে বায়তুল মুকাদ্দাসের নিদর্শন সমূহ তাদের কাছে বর্ণনা করছিলাম ।

উপরের তথ্য হতে আমাদের দাবী হলঃ

১/ আল্লাহ্‌র কাছে দ্রুতগামী বোরাখ সৃষ্টি একেবারেই সহজ ।

২/ রাসুল (সা) যে মিরাজে গিয়েছিলেন তার প্রমান স্বরূপ তিনি কাফেরদের বায়তুল মুকাদ্দাসের বিস্তারিত বর্ণনা দেন যা সব সত্য হয়েছিল এবং কেউই অস্বীকার করতে পারেননি ।

৩/ সময় এর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌ । তাই আল্লাহ্‌ সময়কে পুরপুরি নিয়ন্ত্রণ করাও পসিবল । সময়কে থামিয়ে নবী মুহাম্মদ (সা) কে মিরাজে নিয়ে যাওয়া আল্লাহ্‌র জন্য খুবই সহজ ।

আল্লাহ্‌ সর্বশক্তিমানঃ তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবানঃতিনি সব কিছু করতে সক্ষমঃ

* সুরা আল ইমরান ৩:১৮৯
* সুরা মায়দা ৫:১২০
* সুরা নাহল ১৬:৭০
* সুরা হজ ২২:৬
* সুরা নুর ২৪:৪৫
* সুরা আনকাবুত ২৯:২০
* সুরা রুম ৩০:৫০
* সুরা ফাতির ৩৫:১
* সুরা ফুসসিলাত ৪১:৩৯
* সুরা শুরা ৪২:৯
* সুরা হাদিদ ৫৭:২
* সুরা তাগাবুন ৬৪:১


এমডি আলী

যিনি একজন লেখক, বিতার্কিক ও গবেষক। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ বিষয় পড়াশোনা করেন। ইসলামের সত্যতা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান। “সত্যের অনুভূতি” উনার লেখা প্রথম বই। “ফ্যান্টাস্টিক হামজা” দ্বিতীয় বই। জবাব দেবার পাশাপাশি নাস্তিক মুক্তমনাদের যৌক্তিক সমালোচনা করে থাকেন।

Previous Post Next Post