ইফকের ঘটনা - আয়েশাকে বাঁচাতে মুহাম্মদ নিজেই কুরআনের আয়াত বানিয়েছেন ?

প্রশ্নঃ ইফকের ঘটনা - আয়েশাকে বাঁচাতে মুহাম্মদ নিজেই কুরআনের আয়াত বানিয়েছেন ?

উত্তরঃ এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ

*ইবনে কাসির (রহ) এর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৯৩-৩০১ পৃষ্ঠা । ই,ফা;
* সুলাইমান নদভি (রহ) এর সিরাতে আয়েশা এর ১২০-১৩৩ পৃষ্ঠা । রাহনুমা প্রকাশনী ।
* আর রাহীকুল মাখতুম ।

রাসুল (সা) যখন কোন সফরে বের হতেন তখন স্ত্রী নির্বাচনের জন্য লটারি করতেন । বনু মুস্তালিক যুদ্ধের অভিযানে সফরসাথী হিসেবে লটারিতে আয়েশা (রা) এর নাম আসে । আয়েশা (রা) যাত্রাকালে প্রিয় ভগ্নী আসমা (রা) এর একটি হার ধার নেন । হারটির আংটা এত দুর্বল যে বারবার খুলে যাচ্ছিল । আয়েশা (রা) বয়স ছিল ১৪ বছর । সফরকালে রাতের বেলায় এক অপরিচিত জাগাতে যাত্রাবিরতি হয় । আয়েশা (রা) প্রকৃতির দাকে সাড়া দিতে দূরে চলে গেলেন । ফেরার সময় হটাত গলায় হাত দিয়ে দেখলেন ধার করা হারটি নেই । তিনি প্রচণ্ডে গাবরে গেলেন । প্রথমত তার বয়স ছিল কম আর তার উপরে হারটি ছিল ধার করা । হতভম্ব হতে তিনি হারটি খুজতে লাগলেন । বয়স কম হওয়ার কারনে তার ভ্রমন অভিজ্ঞতা ছিল না । তিনি ভেবেছিলেন যাত্রা শুরু হওয়ার আগেই তিনি হার খুজে পাবেন আর সময়মত হাওদাতে পোঁছে জাবেন । তিনি কাউকে ঘটনাটি জানালেন না, না তাঁর জন্য কাউকে অপেক্ষা করার নির্দেশ দিলেন ।

খুজতে খুজতে হার পেয়ে জান কিন্তু ততক্ষণে কাফেলা রওনা হয়ে গেছে । তারা ভেবেছিল আয়েশা (রা) কাফেলার মদ্ধেই রয়েছেন । এদিকে আয়েশা (রা) কাফেলার স্থানে এসে কাউকে পেলেন না । তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে সেখানেই পড়ে রইলেন । ভাবলেন, যখন কাফেলা বুঝতে পারবে তখন আবার ফিরে আসবে । সাফওয়ান (রা) ছিলেন সে কাফেলার রক্ষণাবেক্ষণকারী । কেউ পিছে পরলে বা কিছু হারিয়ে গেলে তা পৌঁছে দেয়া তাঁর কাজ । তিনি আয়েশা (রা) কে চাঁদর মুড়ি দেয়া অবস্থাতেও চিনতে পারলেন । কারন পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার আগেই তিনি আয়েশা (রা)কে দেখেছিলেন । আয়েশা (রা) তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল । তাঁকে সজাগ করার জন্য সাফওয়ান (রা) জোরে ইন্না লিল্লাহ বলে আওয়াজ দিলেন এবং বললেনঃ এ যে রাসুল (সা) এর সহধর্মিণী ! আল্লাহ্‌ আপনার উপর রহম করুন ! কি করে আপনি পিছে রয়ে গেলেন ? আয়েশা (রা) জবাব দিলেন না । সাফওয়ান (রা) একটি উট এনে তাঁকে আয়েশা (রা) কে আবরণ করতে বলে দূরে সরে দাঁড়ান । আয়েশা (রা) উটের পিঠে আরোহণ করলে তিনি উটের লাগাম ধরে সামনে পথ চলতে থাকেন । অনেক কষ্ট করেও ভরের আগে তাঁরা কাফেলাকে ধরতে পারলেন না ।

+ ঘটনা এখানেই শেষ এবং যে কোন সফরে এমনটা ঘটা একদম স্বাভাবিক কিন্তু যাদের অন্তরে নোংরা চিন্তা রয়েছে তারা এই নরমাল ঘটনাকে নিয়ে কুৎসা রটাতে লাগল । কিন্তু যারা পবিত্র তারা শোনা মাত্রই বলতেন এটা পরিষ্কার অপবাদ ছাড়া কিছুই না । এ ঘটনা সব জায়গায় ছড়ানর মুল হতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ওরফে মুনাফিকদের সর্দার ।

+ এদিকে আয়েশা (রা) মদিনা পৌঁছানোর পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন । তাই তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না আর রাসুল (সা) ভীষণ চিন্তিত ছিলেন যার দরুন তিনি আগের মত আর আয়েশা (রা) এইবার সেবা যত্ন করলেন না ফলে আয়েশা (রা) মনে কষ্ট পেয়ে , রাসুলের অনুমতি নিয়ে নিজ বাপের বাড়ি চলে যান । পরে মেসতাহ (রা) এর মা তাঁকে পুরো ঘটনা বলেন । শুনে আয়েশা (রা) রাত দিন কাদতে থাকলেন ।

+ ঐদিকে আয়েশা (রা) বিরুদ্ধে অপবাদকারীরা আরও জোরে স্বরে তাদের মিথ্যা কুৎসা রটাতে থাকে । প্রায় ১ মাস হয়ে যায় কোন মীমাংসা হয় না । মুনাফিক আর অল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া সবাই মানতেন যে আয়েশা (রা) ছিলেন নির্দোষ । তারপরেও স্বচ্ছতার সাথে রাসুল (সা)তদন্ত করলেন । উসামা ও আলী (রা) সাথে পরামর্শ করলেন । উসামা (রা) বলেন হে আল্লাহ্‌র রাসুল আপনার পরিবার সম্পর্কে আমরা ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না । আলী (রা) আরও তদন্তের পরামর্শ দিলেন । পরে লোকদের জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলেন তাঁর মদ্ধে আমরা দোষের কিছু দেখি না কেবল এতটুকুই যে তিনি তখন ঘুমিয়ে পড়েন ।

+ রাসুল (সা) বুকভরা কষ্ট নিয়ে সবার উদ্দেশে ভাষণ দিলেন । বললেন লোক সকল। মানুষের কি হয়েছে ? তারা আমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে । তারা মিথ্যা বলছে আমার পরিবারের বিরুদ্ধে । এরপরে রাসুল (সা) আবু বকর (রা) এর ঘরে আসেন আর আয়েশা (রা)কে বলেন তুমি তো জানো ঘটনা । আল্লাহকে ভয় করো আর লোকেরা যা বলছে তাতে লিপ্ত হয়ে থাকলে তুমি আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করো । আল্লাহ্‌ তওবা কবুলকারী ।

+ আয়েশা (রা) বলেন আমার সম্পর্কে যেসব কথা বলা হচ্ছে সে ব্যাপারে আমি তওবা করব না । যদি আমি স্বীকার করি তবে আল্লাহ্‌ জানেন যে আমি নির্দোষ। যা ঘটেই নাই তা স্বীকার হয়ে যাবে । ধৈর্য ধরাই উত্তম ।

+ এ পর্যায়ে নাযিল হয়, সুরা নুর ২৪:১১,১৯ নং আয়াতঃ যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে,তারা তোমাদেরই একটি দল । তোমরা একে নিজেদের জন্যে খারাপ মনে করো না, বরং এটা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক । তাদের প্রত্যেকের জন্যে ততটুকু আছে যতটুকু সে গোনাহ করেছে এবং তাদের মদ্ধে যে এ ব্যাপারে আগ্রনি ভূমিকা নিয়েছে , তার জন্য রয়েছে বিরাট শাস্তি । যারা পছন্দ করে যে, ঈমানদারদের মধ্যে বেভিচার প্রসার লাভ করুক তাদের জন্যে ইহকাল ও পরকালে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে । আল্লাহ্‌ জানেন তোমরা জানো না ।

+ বর্তমান সময়ের মর্মান্তিক ইসলাম বিদ্বেষীরা দাবি তোলে "যেহেতু আয়াত নাযিল হতে এক মাসের বেশি সময় লেগেছে" এতে বুঝা যায় মোহাম্মদ আসলে কনফিউজড ছিলেন যে তিনি কি ধরনের আয়াত উপস্থাপন করবেন । তিনি আসলে মাসিক অবস্থা দেখে নিচ্ছিত হতে চাইছিলেন, আয়েশা নির্দোষ কিনা, তানা হলে এক মাস অপেক্ষা কেন ?

= উপরের বিদ্বেষীদের যুক্তিগুলি খুবি দুর্বল কারনঃ

* আয়েশা (রা) থেকে স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক হাদিস এসেছে কিন্তু তিনি কখনো মা হতে পারেননি তাই অবশ্যই এভাবে রাসুল (সা) তাঁকে বিচার করবেন না । আর "রাসুল (সা) তার মাসিকের অপেক্ষায় ছিলেন" এই শব্দে সহিহ হাদিস অথবা বিশুদ্ধ ইতিহাস থেকে তৎকালীন কউল থেকে প্রমান করুন ? এটি একটি ভিত্তিহীন ভুল অনুমান । সুরা নাজম ৫৩:২৮ = সত্যের কাছে অনুমানের কোনই দাম নাই ।

*আয়েশা (রা) তখন রাসুল (সা) এর কাছে ছিলেন না তিনি বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন ।

* ওহী নাজিলের আগেও রাসুল (সা) গুনাহ করে থাকলে আয়েশা (রা) কে তওবা করতে বলেছিলেন । এর মানে ওহী নাজিলের আগে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত দেননি এ ব্যাপারে ।

* যদি নিজেই আয়াত বানাবেন তো সাহাবিদের সাথে পরামর্শের কি দরকার - ইচ্ছা মত বানালেই তো হত ! এর থেকে প্রমানিত হয় যে নবী মুহাম্মদ (সা) নিজে কুরআন আয়াত বানাননি বরং আল্লাহ্‌ই ওহী নাজিলের মাদ্ধমে সত্য কথা ফাঁশ করেছেন ।

+ উইলিয়াম মেইবার তার "লাইফ অফ মুহাম্মদ" বইতে এই ইফকের ঘটনা নিয়ে অনেক অনেক মিথ্যাচার করেছে । যার ভিত্তি নাই । নিজের মনগড়া গল্প বিশুদ্ধ ইতিহাসে ঢুকিয়েছেন যা খুবি মূর্খতার পরিচয় । এই ইসলাম বিদ্বেষী আয়েশা (রা) কে চরিত্রহীন প্রমান করতে চেয়েছেন । যেমন একবার হাসসান (রা) অনুতপ্ত হয়ে আয়েশা (রা) কে কবিতা শোনান - "তিনি পবিত্র , ধৈর্যশিলা , নির্দোষ , তিনি সরলা নারীর গশত খান না" - উইলিয়াম মেইবার এই কবিতা নিইয়ে লিখেন যে, কবিতা খুব চমৎকার কারন তাতে আয়েশা এর পবিত্রতা সৌন্দর্য বুদ্দিমত্তা আর নিখুত কমনীয় দেহের বর্ণনা ছিল ।

= উইলিয়াম মেইবার বাচ্চাসুলভ দাবি করলেন । হাসসান (রা) যখন কবিতাটি পাঠ করেন তখন আয়েশা (রা) এর বয়স ৪০ বছর । তাছাড়া কবিতার কথাও দেহের কথা নাই । লেখক যেই লাইনে বেশি ঘাবলা করেছে তা হলঃ "তিনি সরলা, নারীর গশত খান না" লেখক জানে না আরবি ব্যাকরণে "কারো গশত ভক্ষণ করা" বলতে গীবতকে বুঝানো হয় । আসলে এর দ্বারা বুঝায় যে আয়েশা (রা) কারো গীবত করেন না । অনেক নোংরা বাজে কথা ঐ মূর্খ লেখক উইলিয়াম মেইবার বলার পরেই অবশ্য হতাশ হয়ে লিখতে বাধ্য হন- আয়েশার আগের জীবন আমাদের আশ্বস্ত করে তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিলেন । 

এ ঘটনা থেকে আমরা শিখতে পেরেছি একজন পবিত্র নারীর ওপর বেভিচারের অপবাদ কেউ দিলে তার কি করা উচিত । আর কুরআন নারীর ওপর অপবাদ আরোপ কারীদের শাস্তি আরোপ করেছে । সুরা নুর ২৪:৪= যারা সতিসাধ্যি নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অতপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য কবুল করবে না । এরাই নাফরমান ।

মিসতাহ (রা) ভুলক্রমে এ কুৎসায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন । অথচ তার ভরন পোষণ করতেন আবু বকর (রা) । নিজের মেয়েকে উক্ত অপবাদ দিতে দেখে তিনি মিসতাহ (রা) সাহায্য করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন । তখন সুরা নুরের ২২ নং আয়াত নাযিল হয়ঃ তোমাদের মধ্যে যারা উচ্চ মর্যাদার ও আর্থিক প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন কসম না খায় যে, তারা আত্মীয় স্বজনকে অভাবগ্রস্থকে এবং আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারিদেরকে কিছুই দেবে না। তাদের ক্ষমা করা উচিত এবং দোষত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত । তোমরা কি কামনা করো না যে আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করেন ? আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু । 

এ ঘটনা গুলা প্রমান করে কুরআন রাসুল (সা) এর নিজের কোন পার্সোনাল বই ছিল না । তানা হলে নিজ স্ত্রীকে নিজে বাজে মন্তব্যকারীর সাহায্য বন্ধ হতে দেখে উনার খুশি হওয়া উচিৎ ছিল । এটাই স্বাভাবিক ও মানবীয় । এ ঘটনা বাস্তব প্রমান কুরআন মানুষের তৈরি বই না বরং আল্লাহ্‌র কুরআন এটাই সত্য ।



এমডি আলী

যিনি একজন লেখক, বিতার্কিক ও গবেষক। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ বিষয় পড়াশোনা করেন। ইসলামের সত্যতা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান। “সত্যের অনুভূতি” উনার লেখা প্রথম বই। “ফ্যান্টাস্টিক হামজা” দ্বিতীয় বই। জবাব দেবার পাশাপাশি নাস্তিক মুক্তমনাদের যৌক্তিক সমালোচনা করে থাকেন।

Previous Post Next Post