নিকটবর্তী আসমানে আল্লাহর নেমে আসা

নিকটবর্তী আসমানে আল্লাহর নেমে আসা।

লিখেছেনঃ এমডি আলী।

ভূমিকাঃ

কুরআন ও হাদিসকে নাস্তিকরা নিজেদের মন মতো বানিয়ে ব্যাখ্যা করে ইসলামের সমালোচনা করে থাকে। আল্লাহর নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসার হাদিসকে কেন্দ্র করে নাস্তিকরা মুক্তচিন্তায় নানান অভিযোগ, আপত্তি ও সমালোচনা করে। নাস্তিকরা বলে থাকে আল্লাহ যদি প্রথম আকাশে নেমে আসেন তাহলে উনার জায়গায় তখন কে থাকে? তখন কি সেটা খালি থাকে? আরশ থেকে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন বান্দাদের প্রার্থনা ভালভাবে শোনার উদ্দেশ্যে। এ থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর আরশ থেকে তিনি বান্দাদের প্রার্থনা ঠিকঠাক শুনতে পান না, বা বান্দাদের প্রার্থনা ঠিকঠাক মতো আরশ পর্যন্ত পৌঁঁছায় না। ইত্যাদি সব অভিযোগ গুলো নিয়ে আজকে তদন্ত করে দেখা হবে নাস্তিকদের সমালোচনা করা দাবি গুলো ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক কিনা। আসুন লেখাটি পড়ি।


প্রথম আসমানে নেমে আসার সহিহ হাদিসঃ


সহিহ বুখারী, হাদিসঃ ১১৪৫, সহিহ হাদিসঃ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃআল্লাহ্‌র রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ মহামহিম আল্লাহ্‌ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে। আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন যে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।-ihadis.com


সহিহ মুসলিম, হাদিসঃ ১৬৫৭, সহিহ হাদিসঃ

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ থাকে তখন আমাদের প্রতিপালক মহান ও কল্যাণময় আল্লাহ দুন্‌ইয়ার আসমানে অবতরণ করে বলতে থাকেন : কে এমন আছ, যে এখন আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিব। এখন কে এমন আছ যে, আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আমি তাকে দান করব। আর কে এমন আছ, যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।-hadis.com


সুনানে আবু দাউদ, হাদিসঃ ১৩১৫, সহিহ হাদিসঃ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমাদের মহা মহীয়ান রব্ব প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করে বলেন, আছে কেউ আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো? আছে কেউ আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দান করবো? আছে কি কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো?-hadis.com


সুনানে আবু দাউদ, হাদিসঃ ৪৭৩৩, সহিহ হাদিসঃ

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ রাতের এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকতে আমাদের মহান রব দুনিয়ার নিকটবর্তী আকাশে এসে বলতে থাকেনঃ ওহে কে আছো আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো, কে আছো আমার নিকট কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দিবো, কে আছো আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো।-hadis.com


নাস্তিকরা মুক্তচিন্তায় এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলে থাকে,


আল্লাহ পাক আসলে কানে কম শুনতে পান দেখে প্রথম আসমানে এসে বান্দাদেরকে কাছে বলতে থাকেন আমার কাছে দুয়া করো। নাহলে মুমিনদের দাবি অনুযায়ী আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন তাহলে প্রথম আসমানে কেন উনার আসতে হবে? দরকারটা কি? ধরা যাক, আমি দশতলা একটি বিল্ডিং এর দশতলাতেই থাকি। নিচের তলাতে যিনি থাকেন, তিনি রোজই আমাকে ডাকেন। কিন্তু, আমি শুধুমাত্র সন্ধ্যাবেলাতে দুই তলার বারান্দায় এসে বসে থাকি, তার ডাক শোনার জন্য। ভেবে বলুন তো এই কাজটি আমি কেন করতে যাবো? দশ তলার উপর থেকেই যদি আমি তাৎক্ষণিকভাবে এবং খুব পরিষ্কারভাবে কথাগুলো শুনি, তাহলে আর আমার দুই তলাতে এসে উনার কথা শোনার দরকার হতো না। দশ তলা থেকে পরিষ্কার শোনা যায় না বা বোঝা যায় না, এরকম হলেই আমি শুধুমাত্র দুই তলাতে নেমে তার কথা শোনা শুনবো। কিন্তু আল্লাহর কুদরতের তো কোনো সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না। তাহলে, আল্লাহ কেন আরশ থেকেই প্রার্থনা না শুনে, নিকটবর্তী আসমানে এসে শোনেন? পরিষ্কারভাবে শোনার জন্য? 


মহাবিশ্ব তো আরো অনেক বিশাল, আরো অনেক বড়। এই মহাবিশ্বের বাইরে যদি আল্লাহ থাকেন, তার কাছে প্রার্থনা পৌঁছাতে তো আরো অনেক সময় লেগে যাওয়ার কথা। যদি আমরা দুনিয়াতে বসে তার কাছে দুয়া করি। এই কারণেই কী কারো প্রার্থনা কবুল হয় না? দেখা যায়, প্রার্থনা আল্লাহর আরশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সে বংশশুদ্ধ মরে ভুত হয়ে গেছে। তখন আর প্রার্থনা শুনে কী লাভ? এই কারণেই কী আল্লাহ সময় বাচাতে নিকটবর্তী আসমানে চলে আসেন?


নাস্তিকদের এমন অভিযোগ আর ব্যাখ্যা যখন প্রথম পড়েছি হাঁসতে হাঁসতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। নাস্তিকরা যদি মুক্তচিন্তা বাদ দিয়ে সততার সাথে ইসলামের দৃষ্টিতে হাদিসটি বুঝতে চাইতো তাহলে হয়তো উপরের মিথ্যা ব্যাখ্যা গুলো নাস্তিকরা করতে পারতো না। নাস্তিকরা নাকি তাফসীর গ্রন্থ ও হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ থেকে ইসলামকে ভুল প্রমাণ করে দেয় তো প্রশ্ন হচ্ছে উপরের ব্যাখ্যাটি কোন হাদিস ব্যাখ্যা গ্রন্থে আছে? কোন মুহাদ্দিস উক্ত ব্যাখ্যাটি করেছেন? তাছাড়া নবীজি (সা) কি কখনো বলেছেন আল্লাহ কানে কম শুনতে পান দেখে প্রথম আসমানে নেমে আছেন? বান্দার দুয়া আল্লাহর  পর্যন্ত যেতে পারে না এই কারণে সময় বাঁচাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে যান? সাহাবীগণ কখনো এমন ব্যাখ্যা করেছিলেন কি? অথবা আল্লাহর নেমে আসা মানুষের মতো?


যদি নবীজি (সা) উক্ত ব্যাখ্যা না করে থাকেন, সাহাবীগণ যদি উক্ত ব্যাখ্যা না করে থাকেন, এমনকি সাহাবীগণের কোনো ছাত্র যদি উক্ত ব্যাখ্যা না করে থাকেন তাহলে নাস্তিকদের ব্যাখ্যা কিভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ হতে পারে? ইসলাম যদি সেই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ না করে যেটা নাস্তিকরা করছে তাহলে সেটার জন্য ইসলাম কেন দায়ী হবে? নাস্তিকরা কেন দায়ী হবে না? কুরআন হাদিসের কোথাও তো এসব বলা নেই যে আল্লাহ মানুষের মতো আকাশে নেমে আসেন আর তখন আরশ পুরো খালি থাকে।


উক্ত হাদিসের প্রকৃত সঠিক ও বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা বলার আগে, আগে দেখে নেই নাস্তিকরা উক্ত হাদিস নিয়ে শুধুই অপব্যাখ্যা দেয়নি বরং লজিক্যাল ফ্যালাসি পর্যন্ত করেছে। নাস্তিকরা উক্ত হাদিস নিয়ে STRAW MAN FALLACY অর্থাৎ কাকতাড়ুয়া ভ্রান্তির ফ্যালাসির আশ্রয় নিয়েছে। এখানে যা হয় তা হলো, অন্য কারও কথাকে নিজের মতো করে ঘুরিয়ে-সাজিয়ে অথবা বিকৃত করে বলা হয় যেন আক্রমণ করা সহজ হয়। আপনারা নিজেরাই তো দেখেছেন নাস্তিকরা নবীজি মোহাম্মদ (সা) উক্ত কথাটি বিকৃত করে উপস্থাপন করে আল্লাহর সমালোচনা করেছে যাতে আক্রমণ করা সহজ হয়। ইসলাম নিয়ে নাস্তিকরা এভাবেই নিজেদের ইসলামবিরোধী অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে ফ্যালাসির আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে।


মানুষ যেমনভাবে উপর থেকে নিচে নেমে আসে সেভাবে আল্লাহ মানুষের মতো আরশ থেকে প্রথম আসমানে নেমে আসেন এমন কথা সরাসরি ইসলামের দৃষ্টিতে বাতিল। নাস্তিকদের পুরো অভিযোগটি এটার উপর দাঁড়িয়ে আছে যে আল্লাহ উপর থেকে নিচে নেমে আসলে কি হবে আর কি হবে না অর্থাৎ মানুষের উপর থেকে নিচে নেমে আসার মতো আরকি কিন্তু এটা হাদিসের মিথ্যা ব্যাখ্যা। আসুন সরাসরি কুরআনের আয়াত থেকেই জেনে নেই। কুরআনের এই আয়াত বুঝলেই আল্লাহ বিষয় নাস্তিকদের সকল অন্ধবিশ্বাস দূর হয়ে যাবে।


আল কুরআন, সুরা শুরা ৪২ঃ১১ আয়াতে লেখা আছে,


তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা। তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং চতুস্পদ জন্তুদের মধ্য থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।


তাহলে “আল্লাহর নেমে আসা” এটাও অবশ্যই মানুষের মতো নয় এমনকি কোনো সৃষ্টির মতোই নয়। মানুষের উপর থেকে নিচে আসতে হলে জায়গার পরিবর্তন করতে হয় তাহলে আল্লাহ যদি সৃষ্টির মতো না হয় তাহলে অবশ্যই আল্লাহর নেমে আসতে হলে জায়গার পরিবর্তনের দরকার হবে না। আল্লাহ জায়গার সাহায্য ছাড়াই নেমে আসার ক্ষমতা রাখেন। তাহলে নাস্তিকরা যে এতো ত্যানা পেঁচিয়ে উক্ত হাদিসটিকে নিয়ে সমালোচনা করলো সেটা কি স্পষ্ট প্রতারণা নয়? আসুন বিখ্যাত তাফসীর গুলো থেকে পড়ি।


তাফসীরে ইবনে কাসীর, ড মুজিবুর রহমান,১৬ খণ্ড, ৫১০ ও ৫১১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,


সত্য কথা এই যে, তাঁর মত সৃষ্টিকর্তা আর কেউ নেই। তিনি এক। তিনি বেপরোয়া, অভাবমুক্ত এবং অতুলনীয়। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। আকাশ ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই নিকট সূরায়ে যুমারে এর তাফসীর গত হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, সারা জগতের ব্যবস্থাপক, অধিকর্তা এবং হুকুমদাতা তিনিই । তিনি এক ও অংশীবিহীন । তিনি যার প্রতি ইচ্ছা তার রিযক বর্ধিত করেন অথবা সংকুচিত করেন। তাঁর কোন কাজ হিকমত শূন্য নয়। কোন অবস্থাতেই তিনি কারো উপর যুলুমকারী নন। তার প্রশস্ত জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টজীবকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে


তাফসীরে মাজহারী,১০ খণ্ড, ৪২৭ , ৪২৮ ও ৪২৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,


এরপর বলা হয়েছে— ‘লাইসা কামিলিহী শাইউন' (কোনো কিছুই তাঁর সদৃশ নয়)। এখানে ‘মিছাল' শব্দটি সন্নিবেশিত হয়েছে অতিরিক্তরূপে। এভাবে উদ্দেশ্য দাঁড়িয়েছে— তিনি কোনো কিছুর মতো নন। 'মিছাল' এখানে ব্যবহৃত হয়েছে যথাযথ গুরুত্ব আরোপণার্থে। যেমন অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে— ‘ফাইন্‌ আমানু বিমিছলি মা আমানতুম বিহী' (তারা যদি ইমান আনতো যেরূপ তোমরা ইমান এনেছো)। কারো কারো কাছে ‘কামিছলিহী’ এর ‘কা’ অতিরিক্ত। এভাবে অর্থ দাঁড়ায়— এমন কিছুই নেই, যা তাঁর অনুরূপ। অর্থাৎ তিনি আনুরূপ্যবিহীনহজরত ইবনে আব্বাস কথাটির অর্থ করেছেন— তাঁর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। আবার কেউ কেউ বলেছেন, ‘মিছাল' এখানে রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়েছে অতিশয়োক্তির জন্য। না-সূচক শব্দ ক্রিয়ার অতিশয়োক্তি হিসেবে বিবেচিত হলে যেমন বলা হয়, তোমার মতো মানুষ একাজ করে না। অর্থাৎ তুমি একাজ করো না। সম্বোধনকারীর ‘মিছাল' বা দৃষ্টান্ত যদি সম্বোধিত জনের অনুরূপ বা সমান হয় এবং বলে, সে এ কাজ করে না, তবে সম্বোধিত ব্যক্তির না করাটা মর্যাদার দিক থেকে উত্তম বলে প্রমাণিত হবে। রূপকের জন্য বাস্তব অস্তিত্ব বা তার সম্ভাবনা প্রয়োজনীয় হয়। যেমন কোনো দীর্ঘদেহী লোককে রূপক অর্থে বলা হয় অমুক ব্যক্তি নিজাদ এর মতো লম্বা, তবে এমতোক্ষেত্রে সে যে দীর্ঘদেহী সেটাই বুঝায়। দুজনের আবার আকৃতি অবিকল একরকম হতে হবে, তার কোনো অর্থ নেই। এভাবে ‘বাল ইয়াদাহু মাসুত্বতান' এই আয়াতে হাত লম্বা হওয়া অর্থ দানশীল হওয়া। বাস্তবে হাত লম্বা হওয়া এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য নয়। আর তা সম্ভবও নয়। আবার কারো কারো মতে ‘মিছাল' অর্থ এখানে গুণ । অর্থাৎ তাঁর গুণাবলীর মতো অন্য কারো গুণাবলী নেই। এরপর বলা হয়েছে— 'তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা' । একথার অর্থ— যা কিছু শ্ৰৰণ ও দর্শনের যোগ্য তা তিনি শোনেন ও দেখেন। আর তাঁর শোনা ও দেখার বিষয়টিও আনুরূপ্যবিহীন। অর্থাৎ অন্য কারো মতো নয় । প্রকৃতপক্ষে তিনিই হচ্ছেন শ্রোতা ও দ্রষ্টা। অন্য সকল শ্রোতা ও দ্রষ্টা তাঁর শ্রুতি ও দৃষ্টির মুখাপেক্ষী । অর্থাৎ তাঁর দয়ায়, অথবা তাঁর শ্রুতি ও দৃষ্টির প্রতিচ্ছায়ারূপে অন্যেরা শুনতে ও দেখতে পায়। এভাবে পুরো বক্তব্যটি দাঁড়ায়— আল্লাহ্ সত্তাগত দিক থেকে যেমন অন্য কোনোকিছুর সদৃশ নন, তেমনি সদৃশ নন গুণাবলী এবং কার্যাবলীর দিক থেকেও। তাঁর সত্তা-গুণৰত্তা-কার্যকলাপ সকল কিছুই আনুরূপ্যবিহীন


প্রাচীন কালের কাফেররা যেমন ভাবতো আল্লাহ নাকি মানুষের মতো সেভাবে বর্তমান যুগের কথিত আধুনিক নাস্তিকরাও আল্লাহ সম্পর্কে তেমন ভুল ধারণা পোষণ করে যার কারণেই “আল্লাহর প্রথম আসমানে নেমে আসা”র ব্যাপারকে নাস্তিকরা মানুষের মতো মনে করে নানান ভাবে ত্যানা পেঁচিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব বাতিল ও গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে ইসলাম যা বলে না, ইসলাম না পোষণ করেন না সেটা যদি নাস্তিক মুক্তমনারা পোষণ করে তার জন্য ইসলাম কেন দায়ী হবে?


যদি কুরআনে লেখা থাকতো আল্লাহ মানুষের মতো, অথবা নবীজি (সা) যদি বলতেন আল্লাহ মানুষের মতো আকাশে নেমে আসে অথবা সাহাবীরা যদি এমন কিছু বলতো অথবা হাদিস ব্যাখ্যা কারগণ যদি এসব কিছু বলতো কুরআন সুন্নাহের রেফারেন্স থেকে তাহলে হয়তো নাস্তিকদের সমালোচনা ভ্যালিড হতো উক্ত হাদিস নিয়ে কিন্তু নাস্তিকরা যা বুঝাচ্ছে সেটার পক্ষে তো কোনো প্রমাণই নাই। তাহলে নাস্তিকরা যেই ব্যাখ্যাটি দিচ্ছে সেটা কিভাবে সঠিক হতে পারে? নাস্তিকরাই যে ইসলাম সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাস করছে সেটা কি স্পষ্ট নয়?


ইমাম ইবনে আবীল ইয আল-হানাফী (রহিমাহুল্লাহ) রচিত  “শারহুল আক্বীদা আত্-ত্বহাবীয়া” তে বর্ণিত হয়েছে (১),

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (وَلَا شَيْءَ مِثْلُهُ) তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ঐকমত্যে আল্লাহ তা‘আলার অনুরূপ আর কিছুই নেই। তার সত্তা, সিফাত এবং কর্মসমূহের কোনো তুলনা নেই। ‘‘আল্লাহ তা‘আলাকে মাখলুকের সাদৃশ্য করা থেকে পবিত্র রাখা আবশ্যক’’, এ কথাটি বিভিন্ন ফির্কার মানুষের কথার মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কথায় পরিণত হয়েছে। এ কথার উদ্দেশ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে কথাটি গ্রহণযোগ্য। আর যদি আল্লাহর সুউচ্চ গুণাবলীকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা অগ্রহণযোগ্য। কুরআন সুষ্পষ্ট ভাষায় আল্লাহর সদৃশ অস্বীকার করেছে এবং মানুষের বিবেক ও বোধশক্তির দলীল দ্বারাও সে অস্বীকার সমর্থিত। ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই’’ এ অংশ দ্বারা ঐসব লোকদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা আল্লাহর সিফাতকে মানুষের সিফাতের মতোই মনে করে। আর ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ এ অংশ দ্বারা ঐসব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার ও বাতিল করে। সুতরাং যারা স্রষ্টার সিফাতসমূহকে মাখলুকের সিফাতের অনুরূপ মনে করে, তারা হলো নিন্দনীয় বাতিলপন্থী মুশাবেবহা সম্প্রদায়। আর যারা সৃষ্টির সিফাতকে স্রষ্টার সিফাতের অনুরূপ মনে করে, তাদের কুফুরী খ্রিস্টানদের কুফুরীর মতোই।


হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ কি বলেছেন?

আল্লাহর প্রথম আসমানে নেমে আসা নিয়ে নাস্তিকরা মুক্তচিন্তায় যেই ব্যাখ্যাটি করেছে সেটা যদি আসলেই সঠিক হতো তাহলে কুরআন হাদিসেই এমন কথা থাকতো অথবা হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ কুরআন হাদিসের রেফারেন্স দেখিয়েই সেই ব্যাখ্যা করতো  যে, আল্লাহ কানে কম শুনতে পান, অথবা বান্দার দুয়া সাত আসমান উপরে যেতে পারে না দেখে আল্লাহ দ্রুত আসমানে নেমে আসেন। অথবা পৃথিবী যেহেতু ঘুরছে সেহেতু রাত তো স্থির নয় তাই আল্লাহও পৃথিবীর সাথে সাথে ঘুরছেন। কিন্তু কোনো একজন মুহাদ্দিস কি এমন ব্যাখ্যা করেছেন? নাস্তিকরা নাকি ইসলামের রেফারেন্স থেকেই ইসলামকে ভুল প্রমাণ করে? তাহলে রেফারেন্স কোথায়?


এখন আসুন জেনে নেই, ইসলামের দৃষ্টি উক্ত সহিহ হাদিসটির কি ব্যাখ্যা করেছেন মুহাদ্দিসগণ। উনাদের সঠিক ব্যাখ্যা গুলো জেনে নিলেই পরিস্কার হয়ে যাবে নাস্তিকরা কেমন উঁচু মানের বাটপার।


নাস্তিকদের বানানো ব্যাখ্যাটি আরেকবার পড়ে নেই।

আল্লাহ কী করে শেষ রাতে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে নেমে আসতে পারেন যেখানে পৃথিবীর সর্বত্রই কোনো না কোনো সময় শেষ রাত থাকে? হাদিসে বলা আছে আল্লাহ নাকি শেষ রাতে নিকটতম আসমানে আসেন। আধুনিক যুগে আমরা জানি যে, সব সময়েই পৃথিবীর সব স্থানেই কখনো না কখনো ‘শেষ রাত’ চলে। তাহলে আল্লাহ কীভাবে শেষ রাতে অবতরণ করেন? আল্লাহ কি তাহলে সব সময়েই নিকটতম আসমানে থাকেন? তিনি তাহলে কখন ও কীভাবে আরশের উপরে থাকেন? এটা কি আদৌ কোনো যৌক্তিক কথা?


বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলা হয়েছে (২)---

সব চেয়ে বড় কথা এই যে, তাহাজ্জুদের যে সময় তথা রাত্রের শেষ তৃতীয় ভাগ ঐ সময় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নূর এবং রহমতের বিশেষ দৃষ্টি বন্দাদের অতি নিকটবর্তী হয় এবং স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা গোনাহ মাফ করিবার জন্য, মনোবাঞ্ছা দানের জন্য, দোয়া করার জন্য বন্দাদিগকে ডাকিতে থাকে


বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে আরও বলা হয়েছে(৩),---

প্রত্যেক ক্রিয়াপদের আকার, রূপ ও কৌশল প্রণালীর ধরণ ও রকম উহার কর্তাপদের উপযোগী ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়াই অবধারিত। এখানে ক্রিয়াপদ হইল অবতরণ করা, কর্তাপদ হইল অর্থ পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহ তায়ালা নিরাকার, নিরাধার, অতুলন ; তাই তাঁহার সঙ্গে যে ক্রিয়াপদের সম্পর্ক হইবে সেই ক্রিয়াপদও অনুরূপই হইবে৷ ইমাম মালেক (র:) এ বিষয়ে বলিয়াছেন--উঠা, বলা, অবতরণ করা ইত্যাদি ক্রিয়াপদ যখন আল্লাহ তায়ালার সম্পর্কে ব্যবহৃত হইবে, তখন লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে, এসব, ক্রিয়াপদের মূল অর্থ সুস্পষ্ট, কিন্তু নিরাকার নিরাধার অতুলন কর্তাপদের সংযোগ হিসাবে উহার ধরণ ও রকম অবোধ্য;এই বিষয়ে খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসাবাদ বা আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক অবৈধ। তাই মোসলমানগণ যেরূপ নিরাকার নিরাধার অতুলন আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান রাখিয়া থাকে, তদ্রুপ এসব ক্রিয়াপদও যখন কোরআন বা হাদীছের দ্বারা প্রমাণিত হইবে তখন এই সবের প্রতিও অনুরূপ ঈমান রাখা মোসলমান মাত্রেরই অবশ্য কর্তব্য হইবে


আল্লামা ইবনে হাজার বলেনঃ ইবনে ফুরাক বিভিন্ন শায়েখ থেকে বর্ণনা করেন যে (৪),---

এখানে "ينزل بفتح الياء "  না এখানে  " ينزل بضم الياء " অর্থাৎ নামানো। এবং খোদ আবু হুরাইরা থেকে ইমাম নাসায়ির একটি বর্ণনা এই অর্থকে আরো মজবুত করেঃ আল্লাহর তালা অবকশ দিতে থাকেন যখন অর্ধ রাত্রি অতিবাহিত হয়, তখন তিনি একজন আহবায়ককে নির্দেশ দেন , সে যেন আহব্বান করেন, আছে কী কোন দোয়াপার্থী..... 


ইমাম শাফেয়ী রহঃ বলেন (৫),---

" তিনি আল্লাহ ছিলেন কিন্তু কোন স্থান ছিলনা। অতঃপর তিনি স্থান সৃষ্টি করলেন, এতেও তিনি তার অনাদি গুনেই গুনান্বিত যেমনটি স্থান সৃষ্টি করার পূর্বে ছিলেন (অর্থাৎ তিনি কোন স্থান গ্রহন করেন নি)। আল্লাহর সত্ত্বা ও গুনের কোন পরিবর্তন জায়েয নেই। (অর্থাৎ স্থান সৃষ্টির আগে তিনি স্থান হীন ছিলেন এখন স্থান সৃষ্টি করে তিনি কোন স্থানে দাড়িয়ে বা বসে নেই, নতুবা তা আল্লাহর যাত ও সিফাতকে আগয়ীর ও তাবদীল তথা পরিবর্তন যোগ্য ধরা হবে।


মিশকাতুল মাসাবীহর ব্যাখ্যা গ্রন্থে লেখা হয়েছে (৬),

ইমাম মালেক এবং অন্যান্যরা বলেন, এর অর্থ হলো, আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর রহমত অথবা ফেরেশতাগণ দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবতীর্ণ হন না। এর অনুকূলে বিশুদ্ধ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে-অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ অর্ধেক রাত অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দেন, অতঃপর কোনো আহবানকারীকে আহবান করার জন্য আদেশ প্রদান করেন এবং সে আহবানকারী এই বলে আহবান করতে থাকে যে, কোনো প্রার্থনাকারী আছে কি না? কেননা তার প্রার্থনার মঞ্জুরি প্রদান করা হবে। এর দ্বিতীয় আর একটি ব্যাখ্যা হলো, উক্ত বাক্যটি রূপক হিসাবে আনা হয়েছে। সুতরাং এর অর্থ হবে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা রহমতের মাধ্যমে কবুল করে নেবেন। যেমনিভাবে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি অথবা রাজন্যবর্গ কোনো দুর্বল অসহায়-অনাথের প্রার্থনাকে কবুল করে থাকে। [মিরকাত] উল্লেখ্য যে, আল্লাহর হাত বলতে আল্লাহর করুণা-অনুগ্রহের কুদরতী হাত। দরিদ্র নয় এবং অত্যাচারীও নয় অর্থাৎ আল্লাহ দরিদ্র নন যে, ঋণ শোধ করতে পারবেন না এবং অত্যাচারী নন যে, ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ শোধ করবেন না। আর ঋণ দেওয়ার অর্থ হলো ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে পাওনাদার হওয়া।


আল্লাহ পাক হচ্ছেন যুক্তির অস্তিত্ব দান কারী। আল্লাহ যেভাবে চাবেন যুক্তি সেভাবেই কাজ করতে বাধ্য। যুক্তি আল্লাহর সৃষ্টি। তাহলে বলা যায় যুক্তির অনেক উর্ধে উনি। আল্লাহ চাইলেই এমন যুক্তি সৃষ্টি হওয়া সম্ভব যে, স্থান ও জায়গার পরিবর্তন ছাড়াই আল্লাহ আল্লাহর মতো করে নেমে আসতে পারেন অথবা উপরে যেতে পারেন এমনকি সেটা অবশ্যই সৃষ্টির মতো হবে না। কিন্তু মূর্খ নাস্তিকরা তো আর এসব কথা বুঝতে চাইবে না কারণ এসব বুঝলে তো আর নিজেদের ইসলাম বিরোধী বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না। আমাদেরকে এটাও বুঝতে হবে,একই সাথে দুই স্থানে অবস্থান করা মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে নয়। নাস্তিকরা মানুষের সাথে আল্লাহকে মিলিয়েই প্রথম ভুলটা করেছে এরপরে ধাপে ধাপে মুক্তচিন্তার ব্যাখ্যা বানিয়ে বাকি ভুল গুলো করেছে।


ফেরেশতারাও দিনে এবং রাতে আসেনঃ


নাস্তিকরা আরও বলে,

শুধু যে আল্লাহর রাতের বেলা একটি বিশেষ সময়ে আসেন তা নয়, ফেরেশতাগণও পালাক্রমে দিনে বা রাতে পৃথিবীতে আসেন। কিন্তু দিন বা রাত পৃথিবী নামক গ্রহটির সাপেক্ষে নির্ধারিত হয়। মহাকাশে দিন বা রাত বলে কিছু নেই। মহাবিশ্বের সাপেক্ষে বা মহাবিশ্বের বাইরে বসবাসকারীর সাপেক্ষে দিন বা রাত কোন অর্থই বহন করে না। আসুন হাদিস থেকে পড়ি,


সহিহ বুখারী, হাদিসঃ ৩২২৩, সহিহ হাদিস,আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ফেরেশতামন্ডলী একদলের পেছনে আর একদল আগমন করেন। একদল ফেরেশতা রাতে আসেন আর একদল ফেরেশতা দিনে আসেন। তাঁরা ফাজ্‌র ও ‘আসর সালাতে একত্রিত হয়ে থাকেন। অতঃপর যারা তোমাদের নিকট রাত্রি কাটিয়েছিলেন তারা আল্লাহ্‌র নিকট উর্ধ্বে চলে যান। তখন তাদেরকে মানুষের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। অথচ তিনি তাদের চেয়ে এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত আছেন। তিনি বলেন, তোমরা আমার বান্দাহদেরকে কী হালতে ছেড়ে এসেছে? উত্তরে তাঁরা বলেন, আমরা তাদেরকে সালাতরত অবস্থাতেই পৌঁছেছিলাম।-ihadis.com


পাঠক উপরের হাদিসের কোথায় বলা হয়েছে মহাকাশে দিন বা রাতের সময় ফেরেশতা আগমন করে? অথচ উক্ত হাদিসের মধ্যেই কিন্তু স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ফেরেশতারা ফাজ্‌র ও ‘আসর সালাতে একত্রিত হয়ে থাকেন। তাহলে ফেরেশতারা যে দুনিয়ার রাত ও দিনের কথা বুঝানো হয়েছে সেটা স্পষ্ট। তার থেকে বড় কথা হাদিসে এটাও পরিস্কার করে দেয়া হয়েছে ফেরেশতারা যারা মানুষের সাথে রাত্রে কাটিয়েছেন। কিন্তু নাস্তিকরা তো মুক্তচিন্তা করে তাই হাদিসকে মুক্তচিন্তায় বিকৃত করে বলতেও নাস্তিকদের মনে কষ্ট লাগে না। নাস্তিকরা ইসলামের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার সময় সততাকে খুন করে মিথ্যাকে মুক্তচিন্তায় বন্ধু বানিয়ে নেয় এই কারণে ঠাণ্ডা মাথায় সহজেই মুক্তমনারা মিথ্যাচার করতে পারে। 


আলেমরা লুকোচুরি করেছে, তাই নাকি?

আমরা জানি, চিন্তার মুক্তির আন্দোলনকে সফল করতে কারা লুকোচুরি করে ইসলাম বিরোধী বিশ্বাস প্রচার করে। নাস্তিকরা বলে, স্বাভাবিকভাবেই, যেকোন যুক্তিবাদী মানুষই এই হাদিসটি পড়লে সর্বপ্রথম যা ভাববে, তা হচ্ছে, আল্লাহ সেই সময়ে নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসলে আরশে তখন কে থাকে?


কিন্তু এই ভাবনাটা তখন সঠিক হবে যদি আল্লাহকে হাদিসে মানুষের মতো মনে করা হয় কিন্তু হাদিসে যদি এসব না বলা হয়ে থাকে তাহলে যুক্তিবাদের নামে নাস্তিকদের মিথ্যা ভাবতে হবে কেন? নাস্তিকরা এরপরে বলে, ইমামরা উক্ত হাদিসকে নিয়ে প্রশ্ন করতে মানা করেছেন এমনকি উনারা উক্ত হাদিস নিয়ে আল্লাহ কিভাবে নেমে আসেন সেই ব্যাপারে জানেন না বলেও মত দিয়েছেন যা আসলে অনেক আলেম আবার এই হাদিস নিয়ে আলোচনা, যুক্তিতর্ক, চিন্তাভাবনা করতে নিষেধ করেছেন, যা আসলে তাদের অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বেরই প্রমাণ।


আসলে ইমামগণ তো আর নাস্তিকদের মতো বানিয়ে বানিয়ে মুক্তচিন্তায় মিথ্যাচার করেন না এই কারণে ইমামদের সততার সাথে কথা গুলো নাস্তিকদের ভালো লাগেনি। আল্লাহর নেমে আসার ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে যদি স্পষ্ট কিছু বলা হয়ে না থাকে এমনকি ইঙ্গিতেও তাহলে ইমামগণ কেন সেই ব্যাখ্যা করতে যাবেন? কুরআন ও হাদিসে কোথাও এই কথা বলে নেই যে আল্লাহর নেমে আসার কোনো প্রাণীর মতো তাহলে ইমামগণ কেন নাস্তিকদের ব্যাখ্যা করতে যাবেন? উনারা সততার সাথে সঠিক কথাই বলেছেন যে উক্ত হাদিস যেভাবে আসে সেভাবেই আমাদেরকে মেনে নিতে হবে অথবা বুঝতে হবে। আসুন ইমামগণ যা বলেছেন সেটা পড়ে নেই।


ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাযহাব মালেকী মাযহাবের প্রধান ইমাম, ইমাম মালিকের কাছে আল্লাহর আরশের উপরে ওঠা (ইস্তাওয়া) বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন (৭),


ইস্তাওয়া পরিজ্ঞাত, এর পদ্ধতি বা স্বরূপ অজ্ঞাত, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ’আত এবং এ বিষয় বিশ্বাস করা জরুরী।


ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেছেন (৮),


…আমি আবু আব্দুল্লাহকে (আহমাদ বিন হাম্বল(র.)) বললাম, “আল্লাহ কি দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন? তিনি বললেন, “হ্যাঁ”। আমি বললাম, “তাঁর অবতরণ কি ইলম (জ্ঞান) দিয়ে অথবা কী দিয়ে?” তিনি বললেন, “এই বিষয়ে চুপ করো। তোমার কী দরকার এ বিষয়ে? হাদিসে যেভাবে ‘কীভাবে’ বা সীমা ছাড়া বর্ণিত হয়েছে সেভাবে মেনে নাও। তবে কোন আছার বা হাদিস যদি বর্ণিত হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। অথবা যদি কিতাবে বর্ণিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, “অতএব, আল্লাহর কোন সদৃশ সাব্যস্ত করো না।” (সুরা নাহল ১৬ : ৭৪) ” এর পরে ইবন রজব হাম্বলী(র.) উল্লেখ করেছেন, “ (আল্লাহর) ‘অবতরণ’ বিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে, তার উপর নড়াচড়া, স্থানান্তর, আরশ থেকে খালি হওয়া, না থাকা এ সকল কিছু সাব্যস্ত করা বিদআত। এ ব্যপারে গভীরে অনুসন্ধান করা কোনো প্রশংসনীয় কাজ নয়। 


বিভিন্ন দলিল ও ইজমার আলোকে দারুল উলুম দেওবন্দের ইফতা বিভাগের ফতোয়ায় বলা হয়েছে(৯),


“আল্লাহ তা’আলা আরশের উপর আছেন। আরশের উপর থেকেই তিনি সর্বত্র বিরাজমান, অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান ও কুদরাতের গণ্ডিতেই সব কিছু । কোনো কিছুই তাঁর আয়ত্বের বাহিরে নয়। সকল মুফাসসিরের মতে আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন, তিনি আরশের উপর কিভাবে আছেন। তিনি তাঁর শান মোতাবেক আছেন। যার আকার বা ধারণা আমাদের অজানা। আমাদের এ ব্যাপারে কোনো ইলম নেই। আর এসব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করা উচিৎ। ব্যস, ইমান রাখাই যথেষ্ট আমাদের জন্য।”


প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার শায়খ মুহাম্মদ বিন সালেদ আল উসাইমীনকে প্রশ্নটি করা হয়েছিল। আসুন দেখি শায়খ কী উত্তর দিয়েছিলেন (১০),


প্রশ্ন: (৪১) আমরা জানি যে, রাত ভূপৃষ্ঠের উপরে ঘুর্ণায়মান। আর আল্লাহ রাতের তিন ভাগের এক ভাগ অবশিষ্ট থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। এ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা রাতভর দুনিয়ার আকাশেই থাকেন -এর উত্তর কী? উত্তর: আল্লাহ কুরআন মজীদে নিজেকে যেসমস্ত গুণে গুণাম্বিত করেছেন এবং যেসমস্ত নামে নিজেকে নামকরণ করেছেন তাঁর ওপর ঈমান আনয়ন করা আমাদের ওপর ওয়াজিব। এমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর যে সমস্ত নাম ও গুণাবলী বর্ণনা করেছেন কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন অস্বীকৃতি, পরিচয়ের জন্য ধরণ নির্ধারণ করা বা উপমা পেশ করা ব্যতীত তার উপর ঈমান আনা আবশ্যক। পরিবর্তন সাধারণতঃ হয়ে থাকে আয়াত ও হাদীসসমূহে। আর অস্বীকার হয়ে থাকে আকীদার ভিতরে। ,পদ্ধতি ও উপমা বর্ণনা করা হয় সিফাত তথা গুণের ভিতরে। সুতরাং উপরোক্ত চারটি দোষ হতে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পরিস্কার করতে হবে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে কেন, কেমন? এ ধরণের প্রশ্ন করা যাবে না। এমনিভাবে আল্লাহর গুণাবলীর ব্যাপারে ধরণ বর্ণনার চিন্তা করা থেকে মানুষ সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে অনেক বিষয় সহজ হয়ে যাবে। এটাই ছিল সালাফে সালেহীনের আদর্শ। ইমাম মালেকের রহ. কাছে এক লোক এসে বলল, হে আবু আবদুর রহমান! আল্লাহ তো ‘আরশের উপরে আছেন, তবে কীভাবে? উত্তরে ইমাম মালেক রহ. বললেন, ‘আরশের উপরে থাকার বিষয়টি জ্ঞাত আছে। কীভাবে আছেন তা আমাদের জানার বাইরে। এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব। আর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদ‘আত। 


যে ব্যক্তি বলে যেহেতু রাত সারা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে আর আল্লাহ তা‘আলা রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন, তাই আল্লাহ সারা রাতই এ আকাশে থাকেন। কারণ, শেষ তৃতীয়াংশ তো এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হয়ে থাকে। উত্তরে আমরা বলব যে, এ প্রশ্নটি কোনো সাহাবী করেন নি। যদি প্রশ্নটি কোনো মুসলিমের অন্তরে হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তাহলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন। আমরা বলব পৃথিবীর কোনো অংশে যতক্ষণ রাতের এক তৃতীয়াংশ থাকবে, ততক্ষণ সেখানে আল্লাহর অবতরণের বিষয়টি নিশ্চিতভাবে বাস্তবায়িত হবে। রাত শেষ হয়ে গেলে তা শেষ হয়ে যাবে। তবে আল্লাহর অবতরণের ধরণ আমরা জানিনা। তার সঠিক জ্ঞানও আমাদের কাছে নেই। আর আমরা জানি আল্লাহর মত আর কেউ নেই। আমাদের উচিৎ হবে আল্লাহর কিতাবের সামনে আত্মসমর্পণ করা এবং এ কথা বলা যে, আমরা শুনলাম এবং ঈমান আনয়ন করলাম ও অনুসরণ করলাম। এটাই আমাদের করণীয়।


মুহাদ্দিসগণ এই হাদিসকে আল্লাহ তা’আলার সিফাত (গুণ/বিশেষণ) বিষয়ক হাদিস হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযী (র.) বলেন (১১)


“… এই হাদিস এবং আরো এই ধরণের যে সমস্ত হাদিসে আল্লাহর সিফাত বা প্রত্যেক রাতে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে আল্লাহ তা'আলার অবতরণ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। সে সকল হাদিস সম্পর্কে একাধিক বিশেষজ্ঞ আলিমের বক্তব্য হল যে, এই ধরণের রিওয়ায়াত সমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত। এগুলো সম্পর্কে বিশ্বাস রাখতে হবে। এই সব বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা যাবে না এবং তা কী ধরণের সে সম্পর্কেও প্রশ্ন করা যাবে না। ইমাম মালিক ইবন আনাস, সুফিয়ান ইবন উআয়না, আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (র.) প্রমূখ ইমামদের থেকে এই ধরণের বক্তব্য বর্ণিত আছে। এই ধরণের হাদিসগুলো সম্পর্কে তাঁরা বলেন, “কী ধরণের?” - সে প্রশ্ন না তুলে যেভাবে উল্লিখিত হয়েছে সেভাবেই তা মেনে নাও। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমগণ এ অভিমতই পোষণ করেন। কিন্তু জাহমিয়া সম্প্রদায় এই সমস্ত রিওয়ায়াত অস্বীকার করে ; তারা বলে, এগুলো তা হল উপমাবোধক। … এটি এমন, যেমন আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাবে ইরশাদ করেছেনঃ "কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয় ; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা” (৪২ : ১১)। অতএব, মহান আল্লাহর অন্য একটি বিশেষণ ‘নুযুল' বা অবতরণ। এ সিফাত বা বিশেষণটিকে কিছু প্রাচীন পথভ্রষ্ট ফির্কা জাহমিয়া ও মুতাযিলারা অস্বীকার করতো। তাদের বক্তব্যঃ  স্থান পরিবর্তন আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি আরশ থেকে অবতরণ করলে আরশ কি শূন্য থাকে? তারা আরো বলেঃ অবতরণ অর্থ নৈকট্য বা বিশেষ করুণা।


আল্লাহ কানে কম শুনতে পান দেখে প্রথম আসমানে নেমে আসেন বান্দার দুয়া শুনতে,আল্লাহ প্রথম আসমানে এসে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকেন,আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে আসলে আরশ তখন খালি থাকে--নাস্তিকদের মতো এমন ফালতু মিথ্যা ব্যাখ্যা তো আর ইমামরা করে নি এই কারণে ইমামদের সঠিক ব্যাখ্যাটিকে নাস্তিকরা ইমামদের অক্ষমতা এবং অসহায়ত্বেরই প্রমাণ বলে চালিয়ে দিয়েছে। চিন্তার মুক্তির আন্দোলনের এসব চুরিবিদ্যা মানুষ এখন ভালো বোঝে।


কুরআনের কিছু আয়াত ও ফিকহুল আকবারঃ


আল কুরআন,সুরা মু’মিনুন - ২৩:৮৬ আয়াতে লেখা আছে,

বলুনঃ সপ্তাকাশ ও মহা-আরশের মালিক কে? 


আল কুরআন, সুরা ত্বা-হা - ২০:৫ আয়াতে লেখা আছে,

তিনি পরম দয়াময়, আরশে সমাসীন হয়েছেন।


আল কুরআন,সুরা মু’মিন - ৪০:৭ আয়াতে লেখা আছে,

যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের পালনকর্তার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করে, তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।


আল কুরআন,সুরা হাক্বকাহ - ৬৯:১৭ আয়াতে লেখা আছে,

এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আট জন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের উর্ধ্বে বহন করবে।


আল কুরআন,সুরা যুমার - ৩৯:৭৫ আয়াতে লেখা আছে,

আপনি ফেরেশতাগণকে দেখবেন, তারা আরশের চার পাশ ঘিরে তাদের পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষনা করছে। তাদের সবার মাঝে ন্যায় বিচার করা হবে। বলা হবে, সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর।


এই আয়াত গুলো আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, প্রথম খণ্ড, আল্লামা ইবনে কাসীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ৫৪-৫৯ পৃষ্ঠাতে বিস্তারিত বলা হয়েছে এবং আরশ কুরসি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোথাও এই কথা বলা হয় নি যে আল্লাহর আরশ কুরসি মানুষদের চেয়ার টেবিলের মতো। যদি বলা হতো তাহলে নাস্তিকদের অভিযোগ করার সুযোগ থাকতো কিন্তু এমন কিছুই কোথাও বলা হয়নি। তাই নাস্তিকদের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন সেটা পরিস্কার। 


খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ) লেখা “ইমাম আবু হানিফার আল ফিকহুল আকবার’ বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা” গ্রন্থে যা বলা হয়েছে সেটিও পড়ে নিই, ২৬৩, ২৬৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,


মহান আল্লাহর অন্য একটি বিশেষণ 'নুযূল' বা অবতরণ । এ অর্থের একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ বলেন: “প্রতি রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন আমাদের মহিমান্বিত মহা-কল্যাণময় প্রতিপালক নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন । তিনি বলেন : আমাকে ডাকার কেউ আছ কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব । আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে প্রদান করব । আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছ কি? আমি তাকে ক্ষমা করব।” এ বিশেষণও জাহমী-মু'তাযিলীগণ অস্বীকার করেন । তারা বলেন, স্থান পরিবর্তন আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক । তিনি আরশ থেকে অবতরণ করলে আরশ কি শূন্য থাকে? তাঁরা বলেন: অবতরণ অর্থ নৈকট্য বা বিশেষ করুণা। 


কিন্তু প্রশ্ন হলো: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তো অনেক স্থানেই নৈকট্য ও করুণা শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে রাসূলুল্লাহ (সা) নৈকট্য বা করুণা না বলে অবতরণ বললেন কেন? আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য বিশ্বাসকে কঠিন ও জটিল করতে চান? না সহজ করতে চান? আহলুস সুন্নাতের ইমামগণ অন্যান্য বিশেষণের মত এটিকেও তুলনামুক্তভাবে মেনে নেন। তাঁরা বলেন: এটি মহান আল্লাহর একটি বিশেষণ । আমরা সরল অর্থে বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ অতুলনীয়, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন এবং তিনি যখন এবং যেভাবে ইচ্ছা অবতরণ করেন। তাঁর অবতরণ কোনোভাবেই কোনো সৃষ্টির অবতরণের মত নয় । তাঁর অবতরণের স্বরূপ ও প্রকৃতি কি তা আমরা জানি না এবং জানার চেষ্টাও করি না। ইমাম আবূ হানীফা (রা) কে মহান আল্লাহর অবতরণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তিনি উত্তরে বলেন: “মহান আল্লাহ অবতরণ করেন, কোনোরূপ পদ্ধতি বা স্বরূপ ব্যতিরেকে।”


আল ফিকহুল আকবারে আরও বলা হয়েছে (১২), 

বিশেষণগুলোর অর্থ অজ্ঞাত অথবা জ্ঞাতঃ কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, সালাফ সালিহীন আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো ‘‘অজ্ঞাতঅর্থ’’ বা ‘‘অর্থ বিহীন শব্দ’’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা এগুলোর অর্থ মানবীয় জ্ঞানের আওতা বহির্ভূত বলে গণ্য করেছেন এবং অর্থের বিষয়টি মহান আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। সালাফ সালিহীনের দু-একটি বক্তব্যকে তাঁরা তাঁদের এ মতের পক্ষে প্রমাণ পেশ করেছেন। আমরা দেখেছি সুফইয়ান ইবন উআইনা বলেছেন: ‘‘আল্লাহ কুরআনে নিজের বিষয়ে যে সকল বিশেষণ উল্লেখ করেছেন তার পাঠই তার ব্যাখ্যা কোনো স্বরূপ নেই এবং তুলনা নেই।’’ আওযায়ী, মালিক, সুফিয়ান সাওরী, লাইস ইবন সা’দ প্রমুখ আলিম বলেছেন: ‘‘এগুলো যেভাবে এসেছে সেভাবেই চালিয়ে নাও; কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে।’’ আহমদ ইবন হাম্বাল বলেছেন: ‘‘আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই। ’’ এ সকল বক্তব্যের ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন যে, সালাফ সালিহীনের মতে মহান আল্লাহর বিশেষণগুলোর অর্থ ‘‘অজ্ঞাত’’। কিন্তু আমরা যখন সালফ সালিহীনের বক্তব্যগুলো পূর্ণভাবে পাঠ করি তখন আমরা নিশ্চিত হই যে, তাঁরা এ সকল বিশেষণের অর্থ জ্ঞাত তবে ব্যাখ্যা অজ্ঞাত বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা অর্থ বিশ্বাস করেছেন এবং স্বরূপ, হাকীকত বা ব্যাখ্যার জ্ঞানকে আল্লাহর উপর সমর্পন করেছেন। তাঁরা সর্বদা বলেছেন, এ সকল বিশেষণ পাঠ বা শ্রবণ করলে যা বুঝা যায় তাই এর অর্থ এবং তুলনামুক্ত ও স্বরূপহীনভাবে এ অর্থ বিশ্বাস করতে হবে। এর অতিরিক্ত কোনো অর্থ, তাবীল বা ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা যাবে না


ইমাম আহমদের পুত্র হাম্বাল (রহ) বলেন (১৩),

‘‘বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ প্রত্যেক রাতে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন, মহান আল্লাহকে দেখা যাবে, মহান আল্লাহ তাঁর পদ স্থাপন করেন, ইত্যাদি। এ ধরনের হাদীসগুলো সম্পর্কে আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন: আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই (স্বরূপ সন্ধান বা অর্থ সন্ধান ব্যতিরেকে)।’’

……………এ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। একটি সহীহ হাদীসে রাসূলূল্লাহ ﷺ কিয়ামত দিবসের বর্ণনায় বিভিন্নভাবে মহান আল্লাহর দর্শন, জাহান্নামে তাঁর পদ স্থাপনের ফলে জাহান্নামের সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন:‘‘রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে এরূপ অনেক হাদীস বর্ণিত, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, মানুষেরা তাদের রবকে দেখবে, মহান আল্লাহর পায়ের কথা এবং এ জাতীয় বিষয়াদি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুফিয়ান সাওরী, মালিক ইবন আনাস, ইবনুল মুবারাক, ইবন উ‘আইনা, ওকী ও অন্যান্য ইমাম ও আলিমের মাযহাব এ-ই যে, তাঁরা এগুলো বর্ণনা করেছেন এরপর বলেছেন যে, এ সকল হাদীস এভাবে বর্ণনা করা হবে এবং আমরা এগুলো বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে ‘কাইফা’: কিরূপে বা কিভাবে বলা যাবে না। এভাবে মুহাদ্দিসগণের মত এ-ই যে, এ সকল বিষয় যেভাবে এসেছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে এবং এগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে না, কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং একথাও বলা যাবে না যে, কিরূপে বা কিভাবে? আলিমগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন এবং এটিই তাঁদের মাযহাব।’’


নাস্তিকরা যে বলে আল্লাহ কানে কম শুনতে পান দেখে প্রথম আসমানে আসেন এমন ফালতু কথা সম্পূর্ণ বাতিল। কুরআনের এই আয়াতটি পড়ুন।


আল কুরআন, সুরা বাকারা ২ঃ১৮৬ আয়াতে লেখা আছে,

আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে।


তাছাড়া এই আয়াতটিকে সামনে রেখে যদি এটাও বলা হয় আল্লাহ আকাশে নেমে আসেন কথাটি এভাবে বলা হয়েছে যাতে বান্দা রাতে আল্লাহর কাছে দুয়া করতে উৎসাহিত হয় এবং আগ্রহী হয়ে উঠে তাহলেও ভুল হবে না। চিন্তার মুক্তির আন্দোলনের সৈনিকরা এটাও বলে যে,নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদ কোরআন লেখার সময় জানতেন না যে, পৃথিবী গোলাকৃতি। তিনি পৃথিবীকে সমতল ভেবেই এরকম কথা বলেছেন। তিনি যদি বুঝতেন, পৃথিবী গোলাকৃতি, তাহলে এরকম বলবার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু নাস্তিকদের এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার এবং স্ট্রম্যান ফ্যালাসির আশ্রয়। কারণ পৃথিবীর আকৃতি চ্যাপ্টা এই মর্মে কুরআনে কোনো আয়াত নেই এমনকি নবীজি (সা) লিখতে ও পড়তে পর্যন্ত জানতেন না। এই বিষয় আমার বিস্তারিত লেখাটি পড়ে নিবেন। গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার ছাড়া নাস্তিকদের কাছে সততার সাথে কিছু বলার নেই এই কারণে গায়ের জোরে নাস্তিকরা ইসলাম নিয়ে যা ইচ্ছে তাই মুক্তচিন্তার নামে প্রচার করে। নাস্তিক্যধর্মের মুক্তমনারা আবার সেসব চেটে খায়ও। সমস্ত তথ্য সূত্র সহকারে লেখাটি আপনাদের চিন্তাভাবনার জন্য দেয়া হলো, বুদ্ধি বিবেক বিবেচনা ব্যবহার করে নিজেই সিদ্ধান্ত নিন, মুক্তমনাদের কথাবার্তা কতটা যুক্তিযুক্ত।


রেফারেন্স সমূহঃ

[১] তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই-১

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=63&section=814

[২] মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) লিখিত,বোখারী শরীফের (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), প্রথম খণ্ড,৩৯৮ পৃষ্ঠা। হামিদিয়া লাইব্রেরী।

[৩] মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ) লিখিত,বোখারী শরীফের (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), প্রথম খণ্ড,৪০৪ পৃষ্ঠা। হামিদিয়া লাইব্রেরী।

[৪] আমালুল ইয়াওম ৪৪২ - সুনানে কুবরা ৯ খণ্ড, ১৮০ পৃষ্ঠা।

[৫] ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন ২ খণ্ড,২৪ পৃষ্ঠা।

[৬] আনওয়ারুল মিশকাত শরহে মিশকাতুল মাসাবিহ,২ খণ্ড, ৪৬২ পৃষ্ঠা।ইসলামিয়া কুতুবখানা প্রকাশনি।

[৭] শারহুল ফিকহিল আকবার, মোল্লা আলী কারী,৭০ পৃষ্ঠা।

[৮] ফাতহুল বারী – ইবন রজব হাম্বলী, ৯ম খণ্ড, ২৮০-২৮১ পৃষ্ঠা।

[৯] Darul Uloom Deoband, India

https://darulifta-deoband.com/home/ur/Islamic-Names/155436

[১০]  ফতোয়ায়ে আরকানুল ইসলাম / শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=573

[১১] তিরমিযী শরীফ,৩ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ),৬৫৯ নং হাদিসের আলোচনা,৪০ পৃষ্ঠা।

[১২] আল-ফিকহুল আকবর / ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=7173&fbclid=IwAR0m_Jz19XBY7Jw8F0_Aj1-hP9nHXJlGYdeFlDmJWP4brGr7xI6djpQ1iF4

[১৩] আল-ফিকহুল আকবর/ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=7166&fbclid=IwAR1uGnU0-xscDc6n78ghX_bDSmwdn_SNMoiTMbmuqEvOWEJU_pbbCUL8DXY

===================================

গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক কিছু লেখাঃ


কুরআন পৃথিবীর আকৃতি সমতল চ্যাপ্টা বলে?


সূর্য আরশের নিচে সেজদা দেয় বৈজ্ঞানিক ভুল?


কুরআন হাদিসের দাবি চাঁদের নিজস্ব আলো?


আল্লাহ্‌র কি মানুষের মত অঙ্গপ্রতঙ্গ আছে?


আল্লাহ্‌র আরশ এতই দুর্বল যে কেঁপে উঠে?

===================================


এমডি আলী

যিনি একজন লেখক, বিতার্কিক ও গবেষক। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ বিষয় পড়াশোনা করেন। ইসলামের সত্যতা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান। “সত্যের অনুভূতি” উনার লেখা প্রথম বই। “ফ্যান্টাস্টিক হামজা” দ্বিতীয় বই। জবাব দেবার পাশাপাশি নাস্তিক মুক্তমনাদের যৌক্তিক সমালোচনা করে থাকেন।

Previous Post Next Post