আল্লাহ্‌র আরশ এতই দুর্বল যে কেঁপে উঠে ?

আল্লাহ্‌র আরশ এতই দুর্বল যে কেঁপে উঠে?

লিখেছেনঃ এমডি আলী।


প্রথমে এই বিষয় হাদিস গুলো পড়িঃ


বুখারী,৬ খণ্ড, ৩৫৩ পৃষ্ঠা, পরিচ্ছেদ ২১২২: 

সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মর্যাদা।- ইসলামিক ফাউন্ডেশন


বুখারী, ৬ খণ্ড, ৩৫৪ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩৫৩১, সহিহ হাদিসঃ 

জাবির (রা) বলেন আমি নবী (সা)কে বলতে শুনেছি , সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মৃত্যুতে আল্লাহ্‌র আরশ কেঁপে উঠেছিল । আমাশ (রহ) ... নবী (সা) থেকে অনুরুপ বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যাক্তি জাবির (রা) কে বলল , বারা ইবনে আযিয (রা) তো বলেন জানাজার খাট নড়েছিল। তদুত্তরে জাবির (রা) বললেন, সাদ ও বারা (রা) এর গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কিছুটা বিরোধ ছিল । (কিন্তু এটা টিক নয়) কেননা, নবী (সা) কে "আল্লাহ্‌র আরশ সাদ ইবনে মুয়াজের মৃত্যুতে কেঁপে উঠল বলতে শুনেছি।-ইসলামিক ফাউন্ডেশন


বুখারী, ৬ খণ্ড, ৩৫৩ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩৫৩০, সহিহ হাদিসঃ

বারা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন , নবী করীম (সা) কে এক জোড়া রেশমি কাপড় হাদিয়া স্বরূপ দেয়া হল। সাহাবা কেরাম (রা) তা স্পর্শ করে এর কোমলতা অবাক হয়ে গেলেন, নবী (সা) বললেন এর কমলতায় তোমরা অবাক হচ্ছ? অথচ সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর জান্নাতের প্রদত্ত রুমাল এর চেয়ে অনেক উত্তম অথবা বলেছেন অনেক মুলায়েম।-ইসলামিক ফাউন্ডেশন


বুখারী, ৬ খণ্ড, ৩৫৪ ও ৩৫৫ পৃষ্ঠা, হাদিসঃ ৩৫৩২, সহিহ হাদিসঃ 

বনু কুরাইজা সন্ত্রাসীদের শাস্তি দিতে সাদ ইবনে মুয়াজ এমন ফয়সালা করেন যেটা আল্লাহ্‌র ফয়সালার সাথে মিলে যায়।-ইসলামিক ফাউন্ডেশন


উপরের তথ্য গুলো পড়ে আমরা বুঝতে পারলাম, হাদিসটি হযরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মর্যাদা বর্ণনা করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। সাহাবীর মর্যাদা বুঝাতে উপমা দিয়ে আল্লাহ্‌র আরশ কেঁপে উঠেছে বলা হয়েছে। এরমানে এই না যে আল্লাহর আরশ দুর্বল তাই কেঁপে উঠে। কোনো কিছু কেঁপে উঠা মানে, এটা প্রমাণ হয় না যে সেটি দুর্বল,নরম শক্তিহীন। আমি কোনো আয়াতে , কোনো হাদিসে এমনকি কোনো হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ থেকে এমন কোনো তথ্য পাইনি যেখানে বলা হয়েছে উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে আল্লাহর আরশ দুর্বল এই কারণে মুয়াজ (রা) এর জন্য কেঁপে উঠেছিল। বুঝার সুবিধার জন্য কিছু উদাহরণ দেই। আপনারা বুঝার চেষ্টা করুন।


উদাহরণ ১

মোবাইলে আমরা অনেক সময় ভাইব্রেশন অন করে রাখি যাতে কল এলে মোবাইলে আওয়াজ না হয় এবং মোবাইল কেঁপে উঠে,আচ্ছা এর মানে কি মোবাইল তুলার মতো নরম? উত্তর হচ্ছে না । সুতরাং কেঁপে উঠা মানেই সেটা দুর্বল এই কথা ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক।


উদাহরণ ২

আমরা অনেক সময় বলি "বন্ধু তুমি ক্রিকেট খেলায় এমন ভাবে চার ছক্কা মেরেছ যে পুরা মাঠ তোমার খেলায় কাঁপছিল" আচ্ছা এখন কি কোনো নাস্তিক বলবে যে, এর মানে ক্রিকেট খেলার মাঠ তুলার মতো দুর্বল মানুষ সেখানে খেলতে পারে না?


উদাহরণ ৩

বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের জন্য আয়েশা বেগম এমন কাজ করেছেন এবং এতে সরকার এতো খুশি হয়েছেন সে সরকারের পুরো ভবন কেঁপে উঠেছিল। আচ্ছা এর মানে কি সরকারের ভবন তুলার মত নরম সেটি বাতাসে উড়ে যাবে? সরকারের ভবনের কোনো ক্ষমতা নাই?


উদাহরণ ৪

মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভাবে দেশেকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছিলেন যে পুরো দেশ কাঁপছিল। আচ্ছা এর মানে একটি দেশ নরম তুলার মতো? দেশের মাটি দুর্বল? যেহেতু দেশ কাঁপছিল সেহেতু কি মুক্তিযোদ্ধারা দুর্বল?


উপরের সহজ উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম কেঁপে উঠা মানেই দুর্বল নয়। আমি কিন্তু এটা বলিনি যে মোবাইল ফোনের কেঁপে উঠা, মাঠের কেঁপে উঠা আর আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠা এক। আমি কিন্তু আরশের সাথে কিছু তুলনাও করিনি। আমি উদাহরণ দিয়েছে মাত্র।


ইমামগণ কি বলেছেন?


আবদুল্লাহ ইবনে আল-ইমাম আহমাদ (১০৫৮) এর “সুন্নাতে” কিতাবে আল হাসান (রহ) এর কথাকে উল্লেখ করে বলেন (১), 

মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) এর আত্মা আল্লাহর কাছে আগমন করাতে আল্লাহ অনেক সন্তুষ্ট হয়েছেন সেটা বুঝাতেই উক্ত কথাটি বলা হয়েছে। 


ইমাম আয যাহাবী (রহ) বলেন (২),

আরশ আল্লাহর একটি সৃষ্টি যা তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। যদি তিনি চান যে এটি কাঁপবে, তবে এটি আল্লাহর ইচ্ছায় নড়ে। আল্লাহ তাতে সা’দের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়েছিলেন, যেভাবে তিনি উহুদ পাহাড়ে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, (অর্থের ব্যাখ্যা): “হে পাহাড়। তাঁর সাথে (আল্লাহর) মহিমা ঘোষণা করুন" (সাবা' ৩৪:১০) এবং "সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে, তার পবিত্রতা বর্ণনা কর" [আল-ইসরা' ১৭ঃ৪৪]। অতঃপর আল্লাহ সব কিছুকে এতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং বলেন: "এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা করে" এবং এই সত্য,সহীহ আল-বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ আমরা খাবারের তাসবীহ শুনতাম যেভাবে তা খাওয়া হতো। এটি একটি বিস্তৃত বিষয় এবং আমাদের এটি বিশ্বাস করতে হবে।


ইমাম বাগাবী (রহ) বলেন (৩),

এই তথ্যগুলোকে যেভাবে মনে হয় তা বোঝার জন্য এটি আরও উপযুক্ত। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কথার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, “উহুদ হল একটি পর্বত যা আমাদের ভালবাসে এবং আমরা তাকে ভালবাসি। নবী ও আউলিয়াদের (আল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু) সাথে যা নির্জীব, তার ঝাঁকুনি অস্বীকার করা যায় না, যেমন উহুদ কেঁপে উঠেছিল যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর, উমর ও রা. উসমান (রাঃ) এর উপর ছিলেন এবং নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তা ছেড়ে চলে গেলেন (এবং এর পরিবর্তে মিম্বর ব্যবহার করতে শুরু করলেন) তখন খেজুরের কাণ্ডের স্তম্ভটি দুঃখে কেঁপে উঠল


ফাতহুল বারীতে বলা হয়েছে (৪),

প্রথমত, আত্মার আগমনের আনন্দে ‘আরশ’ আসলে কেঁপে উঠেছিল। দ্বিতীয়ত, সাইয়্যিদুনা সাদ ইবনে মুআয (রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রকৃতপক্ষে মদীনার সেই নেতাদের মধ্যে থেকে ছিলেন যারা হিজরতের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং তার উপর ইসলামের প্রসার ঘটান। তখন এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, আমাদের স্রষ্টার সিংহাসন তার সভায় আনন্দিত হয়েছিল


আরেকটি প্রশ্নঃ

আল্লাহ্‌র আরশের চেয়ে একজন মুমিন বান্দার মর্যাদা কিভাবে বেশি হতে পারে?

খুবই সহজ উত্তর, কোনো মর্যাদাবান জিনিসকে দিয়ে অন্য কাউকে মর্যাদার উদাহরণ দেয়া হলে এর মানে এটি প্রমাণ হয় না যে ঐ মর্যাদারবান জিনিসকে ছোট করা হয়েছে। ঠিক একই ভাবে হজরত সাদ ইবনে মুয়াজ (রা) এর মৃত্যুতে আল্লাহ্‌র আরশ কেঁপে উঠেছিল এর মানে এটি প্রমাণ হয় না যে আল্লাহ্‌র আরশের মর্যাদা কমে গিয়েছে। 


উদাহরণ হিসেবে যদি বলি,ধরুন আপনাকে বলা হল, "ভাই আপনি তো দেখি সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট খেলেন" এর মানে এই না যে সাকিব আল হাসানকে ছোট করা হয়েছে।


একটি হাদিস পড়ি।


সহিহ বুখারি, হাদিসঃ ১৫৯৭, সহিহ হাদিসঃ 

উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি হাজ্‌রে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে বললেন, আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পার না। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। -ihadis.com


দেখুন কাবা ঘরের মতন একটি পবিত্র স্থানের পাথরকে হজরত ওমর (রা) বলছেন হাজ্‌রে আসওয়াদ পাথরের কোনো ক্ষমতা নেই কিন্ত এরমানে এই না যে হাজ্‌রে আসওয়াদ পাথরকে অসম্মান করা হয়েছে অথবা এই পাথরের কোনো গুরুত্ব নাই। যেহেতু আমাদের নেতা নবী মুহাম্মদ (সা) এই পাথরকে চুম্বন করতেন তাই অবশ্যই এই পাথরের মর্যাদা আমাদের কাছে রয়েছে কিন্তু তারমানে এই না যে পাথরটিকে অপমান করা হয়েছে।


রেফারেন্স গুলোঃ

(১) The shaking of the Throne at the death of Sa‘d ibn Mu‘aadh was only because of the joy of the Lord, may He be exalted; it was not a reflection of any imperfection

https://islamqa.info/en/answers/197531/the-shaking-of-the-throne-at-the-death-of-sad-ibn-muaadh-was-only-because-of-the-joy-of-the-lord-may-he-be-exalted-it-was-not-a-reflection-of-any-imperfection


(২) সিয়ার আলাম আল নুবালা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৮৩,১৮৪।


(৩) শরহ আস-সুন্নাহ, ১৪ খণ্ড, ১৮০ ও ১৮১ পৃষ্ঠা।


(৪) ফাতহুল বারী,হাদিস: ৩৮০৩ এবং ফায়দুল কাদির, হাদিস: ২৭৬০।


প্রাসঙ্গিক লেখা গুলো পড়ুনঃ


নিকটবর্তী আসমানে আল্লাহর নেমে আসা


আল্লাহ্‌র কি মানুষের মত অঙ্গপ্রতঙ্গ আছে ?


আল্লাহ রিজিকদাতা হলে মানুষ না খেয়ে মরে কেন ?


বান্দাকে আল্লাহ মোহর মেরে দেন কেন?


মহাবিশ্বকে স্রষ্টা বানায়নি দাবির প্রমাণ কোথায়?


সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?


নাস্তিকান্ধদের হাট্টিমাটিম টিম যুক্তি


এমডি আলী

যিনি একজন লেখক, বিতার্কিক ও গবেষক। বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদ বিষয় পড়াশোনা করেন। ইসলামের সত্যতা মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চান। “সত্যের অনুভূতি” উনার লেখা প্রথম বই। “ফ্যান্টাস্টিক হামজা” দ্বিতীয় বই। জবাব দেবার পাশাপাশি নাস্তিক মুক্তমনাদের যৌক্তিক সমালোচনা করে থাকেন।

Previous Post Next Post